
বাড়ি কি গৃহ!
বাড়ি এবং গৃহের তফাৎ আমি সেইভাবে বুঝেছি কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হকের একটা লেখা পড়ে। তিনি খুব স্পষ্ট ভাষায় বুঝিয়েছিলেন কাকে বলে বাড়ি আর গৃহই বা কী! আসলে কায়কোবাদ স্যার/মুক্তিদির ‘আরণ্যক’ গৃহাঙ্গনের দশম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে ‘আরণ্যক দীপাবলী’ শিরোনামে বহু পরিশ্রমে একটি স্মারকগ্রন্থ নির্মাণ করেছিলাম বছর কয়েক আগে (২০০৬)। ওঁদের অসংখ্য গুণগ্রাহীর অনেকেই লিখেছিলেন এতে। স্যার ও দিদির প্রতি সেই গ্রন্থ ছিল এক ধরনের শ্রদ্ধার্ঘ্য। প্রথম লেখাটাই ছিল হাসানভাইয়ের। শুরুতেই তিনি লিখেছিলেন– ‘‘বাড়িটাকে নিছক বাড়ি করে রাখবেন না, ওকে গৃহ করে তুলুন। বাড়িমাত্রেই গৃহ নয়, নিজের বাড়ি হলেও নয়। বাড়িতে থাকলেও বাড়ি কখনো আপনা-আপনি গৃহ হয়ে ওঠে না। পথ চলতে চলতে ঝড়ে-বৃষ্টিতে গাছতলায় দাঁড়িয়েও খানিকক্ষণ মাথা বাঁচানো চলে, কোনো পোড়ো বাড়িতে আশ্রয় নেওয়া যায়। অন্যের বাড়িতেও ঢুকে পড়া চলে। তারপর আবার বেরিয়ে পড়তে হয় পথে! বাড়িতে বড়ো জোর দেহ আশ্রয় পায়, আর কেউ নয়। তার মানে কিছুই আশ্রয় পায় না, দেহ বাঁচিয়েও মানুষ নিরাশ্রয় থেকে যেতে পারে। বাড়িকে গৃহ করে তুলতেই হবে। বিলিতি ‘সুইট হোম’ নয়, গৃহ, চারিদিকে বাড়ির সমুদ্র, তার মধ্যে গৃহ আর পাইব কোথায়!”
এই চমৎকার লেখাটি আসলে স্যার ও দিদির বাড়ি ‘আরণ্যক’ আসলে যে একটি প্রকৃত গৃহ, সেই অভিধাকেই স্পষ্ট করেছিলেন তিনি। তিনি দেখিয়েছিলেন ওই বাড়ি হল সবার, অর্থাৎ যে আসবেন, তাঁর। অথচ ওঁদের তেমন বৈভব নেই, আড়ম্বর নেই, যা ছিল তা হল ‘আন্তরিকতা’। সেই অন্তরের নিখাদ ভালবাসার সন্ধান যে পায়, সেইই জানে তা কতখানি বহুমূল্য! সেই বাড়িতে একদা সকাল থেকে রাত্রি অব্দি অসংখ্য শিশুসহ নানা ধরনের মানুষ আসত প্রতিদিন। বাড়িতে যেন সবসময় উৎসবের মেজাজ। ভিতর থেকে ভেসে আসত সমবেত স্বরের গান। উঠোনে এক গোলাকার বেদি, তাতে বসত আসর নানাসময়ে। একেই যে বলে প্রকৃত গৃহ সেই থেকে বুঝতে শুরু করি। এমন গৃহের ধারণা আমার মনে তখন থেকেই তৈরি হয়ে যায়।
১৯৯৪ সালে মে মাসে আমি এই হৃদয়পুরে একটি পুরনো বাড়ি কিনে সেখানে থিতু হই। চার কাঠার সেই ছোট্ট দোতলা বাড়ির চারপাশে অজস্র সবুজের সমারোহ। আর তার মধ্যেই প্রাণ প্রতিষ্ঠা করলাম আরণ্যক গৃহাঙ্গনের অনুসরণে। আমার সাধ্য সীমিত। তবু যতটা পারলাম, করলাম। অনতিবিলম্বে শিশুদের কলকাকলিতে মুখরিত হয়ে উঠল আমাদের বাড়ি ‘আনন্দধারা’। এই নামে অনেক বাড়ি আছে জেনেও কীভাবে যেন এটাই বহাল হয়ে গেল। শুরু করলাম নানা অনুষ্ঠান নানারকম উপলক্ষকে কেন্দ্র করে। অনতিবিলম্বে আমাদের গৃহাঙ্গনে একটা মুক্তমঞ্চও তৈরি করলাম। শিশুদের প্রাণবন্ত উপস্থাপনা হল সেই মঞ্চে, নানাসময়ে। এইভাবে এগারো বছর ধরে পথ চলার পরে আমাকে থামতে হল। কিন্তু আমাদের আশ্রয় ওই বাড়িটা তো রয়েই গেল।
এবার একটু একটু করে বাড়িটাকে গৃহ করে তোলার চেষ্টায় ব্রতী হলাম। বাড়িটাকে সাজালাম মনের মতো করে। আমার সাধ যত, সাধ্য ছিল না তত। তবে এটা বুঝলাম বাড়িকে গৃহ করে তুলতে অর্থ লাগে না, লাগে আন্তরিকতা এবং হৃদয়ের আকুলতা। আমাদের তিনজনের বাড়ি ক্রমে হয়ে উঠল অনেক মানুষের আশ্রয়, যাকে বলে গৃহ। আমাদের বাড়িতে এলেন কত না মানুষ! নামি অনামি। এলেন শঙ্খ ঘোষ, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, ট্রুডবার্টা দাশগুপ্ত, হায়াৎ মামুদ, হাসান আজিজুল হক, বিষ্ণু বসু, মনোজ মিত্র, সুধীর চক্রবর্তী, প্রতুল মুখোপাধ্যায়, বিপ্লব বন্দ্যোপাধ্যায়, বাসুদেব দাশগুপ্ত, সব্যসাচী দেব, ব্রাত্য বসু, তানভীর মোকাম্মেল, লুৎফর রহমান, হামিদ কায়সার, জাকির তালুকদার, গোলাম সারোয়ার, নিশাত জাহান রানা, শহীদ ইকবাল, ওয়াসি আহমেদ, শোভন তরফদার, সাধন চট্টোপাধ্যায় এবং আরো কত চেনা অচেনা মানুষ। গানে গল্পে আড্ডায় মেতে উঠতে থাকলাম আমরা। এমন সব মানুষের নিত্য আনাগোনায় আমরা বুঝতে পারলাম প্রকৃত গৃহ কাকে বলে। এই আনন্দময়তা আমরা বিগত সাতাশ বছর ধরে বহন করছি। সম্প্রতি একটি ঘটনায় আমরা নতুন করে যেন উদ্দীপ্ত হয়ে উঠলাম।
আমাদের এই গৃহ নিয়ে ফেসবুকে লিখলেন আনন্দবাজার পত্রিকার একজন সাংবাদিক শিশির রায়। ও আমার ছোট ভাইয়ের মতো। বেশিদিনের পরিচয় নয়, মাত্র বছর পাঁচেকের। কিন্তু ইতোমধ্যে অনেক কাছের মানুষ হয়ে গেছে ও। ওকে ঘিরে তৈরি হয়েছে আমাদের সমমনস্ক কয়েকজনের এক বন্ধুবৃত্ত। মাঝে মাঝেই আমরা মিলিত হই। এদিক ওদিক বেড়াতে যাই। এমনই এক ছোট্ট মিলনোৎসব আমাদের গৃহে হয়ে গেল এরমধ্যে একদিন। একটা চমৎকার দিন কাটালাম আমরা কয়েকজন মিলে। সেই অভিজ্ঞতাই উঠে এল ওর লেখায়। ওর সেই ছোট্ট লেখাটায় ও লিখেছে– “বাড়ি তো কেবল বাড়ি নয়, ঘর। আবার ঘর শুধু ঘর নয়, পীঠ। চারু-কারুকলায়, লাবণ্য আর নান্দনিক, শিল্পিত ঠিকানা। সুশীলদার হৃদয়পুরের এই বাড়িটি এই সব কিছু। এক-একটি, তার দেওয়াল, কোণ, মেঝে, বারান্দা, সিঁড়ি, সব এখানে শিল্পীত পরিসর এক। এখানে সময় কাটানো মানে নন্দন-আনন্দের সঙ্গে কথোপকথন। সঙ্গ, আড্ডা খাওয়াদাওয়া হাহাহিহির সমান্তরালে এক সুন্দরের হাত ধরে থাকা।’
ফেসবুকে যা হয়, সঙ্গে সঙ্গে দেখলাম অনেক চেনা ও অচেনা মানুষের নানারকম অভিমত। দেখলাম আমাদের হৃদয়পুরের অনেক অচেনা মানুষও তারমধ্যে আছেন। অনেকে আসতে চাইছেন এখানে, স্বচক্ষে দেখতে চাইছেন আমাদের এই ছোট্ট গৃহ। অনেকের কথা মনকে স্পর্শ করল। তবে জানতাম এগুলো সবই কথার কথা। এই দুঃসময়কালে কে আর আসবে! তবু আমি লিখলাম ওখানেই– “সবার জন্যে উন্মুক্ত এই গৃহাঙ্গন। আহামরি কিছু নয়। সারাজীবন ধরে শিল্পের সাধনা করেছি। ভালবেসেছি নান্দনিক নানা বিষয়কে। তারই কিছু সামান্য আয়োজন বাড়িটাকে ঘিরে। আর ওই হাহাহিহি!!! ও তো এক হাতে তালি দেবার মতো ব্যাপার নয়। হৃদয় দুয়ার খুলে যাঁরা আসেন তাঁরা তাঁদের অজান্তেই কিছু নেবার ছলে অনেক কিছুই দিয়ে যান যে!!
কী জানি ভুল কিছু লিখলাম না তো!’