
রুদ্ধ দ্বার মুক্ত প্রাণ
অবরুদ্ধ সময়ের দিনলিপি কিংবা এক দুর্বিনীত কালক্ষেপের সালতামামি
বিগত বছর দেড়েক ধরে যে দুঃসময়ের মধ্যে আমরা রয়েছি তা আর বেশি আলোচনার অপেক্ষা রাখে না। নানাভাবে আমরা সবাই কমবেশি ভুক্তভোগী। কত মানুষ চলে গেছেন এইসময়! যাঁদের অভাবে আমরা সত্যিকারের রিক্ত হয়েছি আছেন এমন অনেকজন। অনেকেরই এত অল্প বয়সে চলে যাবার কথা ছিল না। তবু সবই তো মেনে নিতে হয়! মেনে আমরা নিয়েছি ঠিকই। তবে আমাদের যাপনবৃত্তান্ত কিন্তু সবার একরকম নয়। সকলের বিয়োগব্যথাও ভিন্ন হতে বাধ্য। আমার নিজের এই অবরুদ্ধ সময়ের দিনলিপিতে মনোনিবেশ করতে গিয়ে প্রথমেই যাঁর কথা মনে এলো তিনি আমার অলোকদা, শ্রদ্ধেয় অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত। এই অতিমারির সূচনাকালে তাঁর একটি অসামান্য বেতার ভাষণ শুনে উদ্দীপ্ত হয়েছিলাম। যেভাবে আমরা এতদিনে প্রকৃতি সংহার করেছি তার প্রতিকল্পে এই শাস্তিবিধানের মধ্যে তিনি যে অনাগত কালের দুঃস্বপ্ন দেখেছিলেন, জীবনানন্দের কবিতার ব্যবহারে তাকে অমোঘ করে তুলেছিলেন। সেই তিনিই হঠাৎ আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন ২০২০ সালের সতেরই নভেম্বর। আমাদের রিক্ত নিঃস্ব হবার সেই শুরু।
তবে তারও অনেক আগে, প্রথম লক-ডাউনের সূচনা পর্বের দমবন্ধ অবরুদ্ধ সময়ের হাত মুক্তি পেতে মাসতিনেক আমি আর অরুণিমা প্রতি সন্ধ্যায় গান নিয়ে বসতে শুরু করেছিলাম। রবীন্দ্রসংগীত দিয়ে শুরু, তারপর নজরুলগীতি, আধুনিক ইত্যাদি হতে থাকল। ভুলে যাওয়া অনেক গান আমাদের কণ্ঠে ধরা দিল নতুন করে। সেগুলো রেকর্ড করে পাঠাতে থাকি প্রিয়জনদের। তাঁদের মূল্যবান মতামত আমাদের প্রাণিত করল। দিনের একটা বড় সময় কাটত এইভাবে। গান নিয়ে এমন আত্মস্থ হইনি বহুদিন, গানের মধ্যে ডুবে থেকে সেই সময়ে আত্মশুদ্ধির এক মহামন্ত্র যেন পেয়েছিলাম আমরা।
রবীন্দ্রগানে মনোনিবেশ করতে করতে তখন কিছু লেখার কথা মাথায় এল। গীতবিতান আমার অতি প্রিয় এক গ্রন্থ। এবার সেই গ্রন্থেই নতুন করে মন দিতে দিতে আমার এতদিনকার অনেক ভাবনা চিন্তা চলে এল কাগজের পাতায়। সেই গান নিয়ে ভাবতে ভাবতে কয়েকটি নিবন্ধের জন্ম হল এইভাবে। বহুদিনের জমে থাকা ভাবনাগুলো বেরিয়ে এল একসঙ্গে এইভাবে। তখনই সাহসে ভর করে আমার সুধীরদা, অর্থাৎ কৃষ্ণনাগরিক সুধীর চক্রবর্তীকে সেগুলো পাঠালাম মতামত পাবার আশায়। লক ডাউনের মধ্যেও আধুনিক প্রযুক্তির কল্যাণে সেগুলো অতি দ্রুতই পৌঁছে গেল তাঁর হাতে। এ ব্যাপারে সহায়তা দিলেন আরেক কৃষ্ণনগরবাসী বন্ধু অনির্বাণ জানা। কিছুদিনের মধ্যেই সুধীরদার অত্যন্ত সদর্থক মতামত এসে গেল। ওগুলো গ্রন্থাকারে প্রকাশের পক্ষে অভিমত দিলেন। তখন সাহসে ভর করে তাঁকে ওর একটা ভূমিকা লিখে দেবার জন্যে বিনত অনুরোধ জানালাম। সে কথাও তিনি রাখলেন। আমার পরম সৌভাগ্য যে সেই লেখাটাও আমার হাতে এসে গেল কয়েকদিনের মধ্যে। দায়সারা কিছু নয়, হাজার দেড়েক শব্দের সেই লেখাটা পেয়ে আমি খুশিতে ভুলে গেলাম তখনকার দুঃসময়ের কথা। নির্লজ্জের মতো বাংলাদেশের এক প্রকাশকবন্ধুকে জানালাম সেই গ্রন্থ প্রকাশের অভীপ্সা। ভাগ্য আমাকে তখনও বঞ্চিত করেনি। সেই প্রকাশনার কর্ণধারের সম্মতি এসে গেল যথাসময়ে। ব্যবসার সমূহ ক্ষতি ভুলে গিয়েও তিনি আমার পাশে এসে দাঁড়ালেন। গ্রন্থটির (গানের সুরের আসনখানি) নির্মাণ শেষ হল। কিন্তু যাঁর হাতে তুলে দিয়ে ধন্য হতে চেয়েছিলাম সেই সুধীরদাই আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। ২০২০ সালের ১৫ ডিসেম্বর সেই মহা দুঃখের কালো দিন এল আমাদের। ‘এবার দুঃখ আমার অসীম পাথার পার হল’।
যাঁর সান্নিধ্যধন্য হয়ে জীবন আমার বর্ণময় হয়েছে সেই শঙ্খদা অর্থাৎ শঙ্খ ঘোষ আমাকে হঠাৎ একদিন ফোন করে ডেকে পাঠিয়েছিলেন ওঁর বাড়িতে। তখন এই দেশে করোনা কালের সূচনালগ্ন কেবল। গেলাম তাঁর বাড়িতে গত বছরের (২০২১) ১৪ মার্চ। সেদিন আরো কয়েকজন ছিলেন সেখানে। আমাকে অবাক করে আমারই হাতে তুলে দিলেন তাঁর সদ্য প্রকাশিত বই ‘ভাষণমালা’ (যুক্ত, ঢাকা, বাংলাদেশ)। পাতা ওল্টাতেই দেখি উৎসর্গপত্রে আমার নাম। তার পাশে লেখা ‘দুই বাংলার নিরর্গল সেতু’। কী যে আনন্দ হয়েছিল সেদিন! সেই আনন্দের রেশ বয়ে বেড়ালাম সারা বছর। ওদিকে শঙ্খদার শরীরের অবনতির খবর নিত্য পাচ্ছি। তারই মধ্যে মাঝে মাঝে তাঁর ফোনকল পাই। কথা প্রায় কিছুই বুঝতে পারি না। অন্যের সহায়তায় সেগুলো বুঝতে হয়। দরকারি অনেক কথা তিনি বলেন। কালি ও কলমের সম্পাদক আবুল হাসনাতের আকস্মিক চলে যাওয়ায় তাঁর মর্মবেদনার শরিক হয়েছি। ওঁকে নিয়ে একটি লেখা চেয়েছিলাম। কী অসীম ধৈর্যে অন্যের সাহায্য তাঁকে নিয়ে একটা লেখা তিনি দিয়েছিলেন একেবারে শেষ মুহূর্তে। কিন্তু তাড়াহুড়োয় একটা ভুল ছিল সেই লেখায়। একই নামের অন্য এক লেখকের লেখার কথা উল্লেখ করেছিলেন তিনি তাতে, নিতান্তই অনবধানবশত। যথাসময়ে সেটা তিনি জানতে পারলেন। সেটুকুর জন্যে তাঁর আক্ষেপের কথা জেনে কী খারাপই না লেগেছিল আমার! অবশেষে এল তাঁর সেই ভ্রম সংশোধনের স্বতঃপ্রণোদিত একটি চিঠি। কালি ও কলম পত্রিকায় সে চিঠি ছাপা হয়ে গেলেও হয়তো তা অনেকের চোখে পড়েনি। এক্ষণে তার একটি বড় অংশ এখানে দিচ্ছি ব্যতিক্রমী একজন মানুষের ভ্রম সংশোধনের এক অসামান্য নজির হিসেবে।
“কালি ও কলম পত্রিকার বর্তমান সম্পাদক সমীপে প্রীতিভাজনেষু,
আবুল হাসনাতের আকস্মিক প্রয়াণ-সংবাদে একেবারে হতবিহবল হয়ে পড়েছিলাম। বিহবলতার রেশ একটু কাটল যখন, মনের মধ্যে জেগে উঠতে থাকল আমাদের পঁয়তাল্লিশ বছরের পরিচয়ের নানা মুহূর্ত। আর ঠিক সেই সময়েই সুশীল সাহার সুত্রে ‘কালি ও কলম’ পত্রিকার জন্য এ বিষয়ে আমার কোনো প্রতিক্রিয়া জানাবার আহবান পেলাম। ইতস্তত না করে আমার পক্ষে যথাসম্ভব দ্রুত একটি লেখন পাঠিয়েছিলাম প্রয়াত বন্ধুর প্রতি আমার শ্রদ্ধাঞ্জলি হিসেবে।
কিন্তু অতি-তৎপরতার ফলে সে-অঞ্জলি হয়ে দাঁড়িয়েছে তাঁর স্মৃতির এক অপমান। কেবল তাঁকেই নয়, এ লাঞ্ছনা তাঁর সমস্ত আত্মীয়জন, তাঁর বন্ধুজন, তাঁর পাঠকবর্গ সকলেরই প্রতি অপমানতুল্য। এজন্য সবারই কাছে নিঃশর্ত ক্ষমাপ্রার্থী আমি।
অনেকেই হয়তো জানেন (বা অনেকেই জানেন না) যে গত কয়েক বছর ধরে লেখা বা পড়ার জন্য অন্যের সাহায্য নিতে হয় আমাকে। সেই কারণে যাকে ‘দ্রুত’ ভাবছি তাও হয়তো অনেকটা বিলম্বিত হয়ে দাঁড়ায়। লিখবার জন্য যেসব বইপত্র জড়ো করেছিলাম টেবিলে, খেয়াল করিনি ‘বিনিময় অবিরাম’ নামে লেখা একটি বই বস্তুত আমারই অতি-পরিচিত আর এক বন্ধু আবুল হাসনাতের, যিনি বিরল এক শ্রদ্ধেয় মানুষ রেজাউল করিম সাহেবের বংশের এক গুণী আর এক পণ্ডিত মানুষ। ফলত, আমার যে অন্যায় ঘটেছে সেটা তাঁরও প্রতি বিষম এক অকৃতজ্ঞতা। আমি ক্ষমাপ্রার্থী তাঁরও কাছে।
…কিন্তু তাতে যে আমার অপরাধের কোনো স্খালন ঘটবে, এমন নয়। সকলেরই জীবনে এমন একটা সময় আসে যখন তাকে ভাবতে হয় লেখা থামিয়ে দেওয়ার কথা। বর্তমান ঘটনাটি বোধহয় আমাকে বুঝিয়ে দিচ্ছে যে আমারও সেই সময় উপস্থিত।
শঙ্খ ঘোষ
৩০ জানুয়ারি ২০২১
শ্রুতিলিখন কৃতজ্ঞতা : স্নেহাশিস পাত্র
চিঠির একটি বড় অংশ তুলে ধরলাম ইচ্ছে করেই। অমন একজন বড় মানুষ কেন অন্যদের থেকে একেবারেই আলাদা তার একটু পরিচয় দিতে ইচ্ছে করল। আজ যে তাঁকে বাংলা ও বাঙালির বিবেক বলা হচ্ছে, তার শিকড় সত্যি সত্যি অনেক গভীরে! এমনি এমনি সেই অর্জন সম্ভব হয়নি। তিনি যে অন্য সবার থেকে একেবারেই আলাদা ছিলেন তার অন্যতম এক প্রমাণ হিসেবে রইল ওই চিঠিটা।আমাদের নিঃস্ব করে সেই মানুষটাই চলে গেলেন ২০২১ এর একুশে এপ্রিল।
একের পর এক প্রিয়জনের চলে যাওয়া, কর্মহীন নিস্ফলা জীবন আর সত্যিকারের একঘেয়ে দিনযাপনে যখন একেবারেই অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছি, তেমন একদিনে আমার শরীরেও কোভিদ ১৯-এর জীবাণুর অনুপ্রবেশ ঘটল। সব সাবধানতা হার মানল। তার রেশ ধরে কীভাবে অতিক্রম করলাম একুশ দিনের নিভৃতবাসের সেই দুঃসহ সময়, সে তো এক অন্য গল্প। সেই দুর্বিনীত সময়ের কথা বলতে হবে অন্য এক পরিসরে, এখানে নয়।*
…
*লেখার শিরোনামে কথাসাহিত্যিক সত্যেন সেনের একটি বিখ্যাত গ্রন্থনাম (১৯৬৩) সকৃতজ্ঞ ঋণস্বীকারপূর্বক উল্লেখ্য।